বৃহস্পতিবার, ২ শ্রাবণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ / July 17, 2025
Logo
আজকের শিরোনাম:

অন্যান্য

শিশুকে যৌন নির্যাতন : ঝুঁকি নির্ণয় ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা

Picture of the author

24 Bangladesh

১১ জুলাই, ২০২৫ | 8:58 AM

Picture of the author

সম্প্রতি ঢাকার সুনামধন্য একটি স্কুলের এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে ছাত্রীদের যৌন হয়রানির ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পর তা দেশজুড়ে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে। এর আগে গত আগস্টে ঢাকা আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের আরও একটি চাঞ্চল্যকর ঘটনা সামনে এসেছিল, যার রেশ অবশ্য এখনো কাটেনি।


গত ২৯ ফেব্রুয়ারি ১১ বছরের এক ছেলে-শিশুকে যৌন নির্যাতনের ঘটনায় এক ব্যবসায়ীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে চট্টগ্রামের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল। গত নভেম্বরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা কেন্দ্রের এক চিকিৎসকের বিরুদ্ধে শিশু যৌন হয়রানির অভিযোগে মামলা করেন ওই শিশুর মা। গত জানুয়ারিতে নোয়াখালির একটি মাদ্রাসায় ১০-১২ বছর বয়সের চারজন শিক্ষার্থীকে বলাৎকারের ঘটনায় এক শিক্ষক গ্রেফতার হয়েছেন। গত ১২ মার্চ নারায়ণগঞ্জে টিভিতে কার্টুন দেখানোর প্রলোভন দেখিয়ে দুই শিশুকে ধর্ষণের মামলায় একজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। সাম্প্রতিক আলোচিত মাত্র কয়েকটি ঘটনার চিত্র এটি। বিভিন্ন বয়সের শিশুর প্রতি যৌন নির্যাতন ও হয়রানির ঘটনা প্রতিনিয়তই দেশের সংবাদমাধ্যমগুলোতে উঠে আসছে। এছাড়া এমন আরও অসংখ্য ঘটনা আড়ালে পড়ে আছে। গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, যৌন নির্যাতনের শিকার ৫৫ শতাংশ শিশু পরিবারের ঘনিষ্ঠজন, বন্ধু ও আত্মীয়দের মাধ্যমে যৌন অপব্যবহারের শিকার হয়। শিশুর যৌন নির্যাতনের এমন ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে, শিশুরা নিজ বাসা থেকে শুরু করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত কোথাও যেন নিরাপদ নয়।


শিশু যৌন নির্যাতনের ঝুঁকি নির্ণয়

শিশুদের প্রতি যৌন হয়রানির প্রবণতা নতুন কোনো বিষয় নয়। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সরাসরিইন্টারনেটের মাধ্যমে শিশুর প্রতি যৌন হয়রানির নতুন নতুন মাত্রা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। গবেষণার তথ্য বলছে, ঢাকার ৬০ শতাংশ শিশু নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হয় এবং নির্যাতিত শিশুদের ৭৫ শতাংশই যৌন নির্যাতনের শিকার। বিকৃত মানসিকতার একটি শ্রেণি যৌন তৃপ্তি মেটানোর জন্য অথবা শিশুদের ক্ষতি করার লক্ষ্যে এই পথ বেছে নেয়। কখনো কখনো শিশুরাও বিকৃত কনটেন্ট থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে অন্য শিশুদের প্রতি যৌন হয়রানির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিভিন্ন গবেষণায় এমন কিছু বিষয় উঠে এসেছে যেগুলো শিশুদের প্রতি যৌন হয়রানির ঝুঁকি বৃদ্ধির অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। তার মধ্যে প্রধান কয়েকটি বিষয় হলো-

১. বাড়ির অশান্ত পরিবেশ : অশান্ত পরিবেশে, বিশেষ করে পরিবারে যখন অস্থিতিশীল পরিবেশ বিরাজ করে তখন শিশুরা প্রবলভাবে স্নেহ-ভালোবাসার অভাব অনুভব করে। তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাসেরও ঘাটতি সৃষ্টি হয়। শিশুদের এই মানসিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে কুকর্মকারীরা তাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে এবং চাটুকারিতা বা উপহারের (চকলেট, আইসক্রিম ইত্যাদি) প্রলোভন দেখিয়ে যৌন সুবিধা লাভের চেষ্টা করে। বা

২. নজরদারিবিহীন টেকনোলজির ব্যবহার : ইন্টারনেট যেমন নানা কল্যাণে কাজে লাগছে, একইভাবে অপরাধীদের জন্য এটি একটি বড় প্ল্যাটফর্ম। শিশুদের হাতে যখন স্মার্ট ডিভাইস ও ইন্টারনেটের সুবিধা থাকে, তখন কুকর্মকারীরা তাদের অনৈতিক যোগাযোগ ও অবৈধ কনটেন্ট দিয়ে শিশুদের হয়রানি করে থাকে। হয়রানির শিকার অনেক শিশুর মানসিক বিকৃতিও ঘটে যা অন্য শিশুদের ওপর প্রভাব ফেলে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে অসংখ্য শিশু যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে। এমন হয়রানির শিকার অনেক শিশুর মৃত্যু পর্যন্ত হয়েছে। এ বিষয়ে গত ৩১ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ভুক্তভোগী শিশুদের জন্য ক্ষমাও চেয়েছেন ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক মার্ক জাকারবার্গ।

৩. বাবা-মায়ের সঙ্গে যোগাযোগে ঘাটতি: বাবা-মায়ের সঙ্গে শিশুরা যখন উন্মুক্তভাবে কথা বলতে না পারে, তখন তাদের মধ্যে দূরত্ব, বিচ্ছিন্নতা, অনিরাপদ অনুভূতি এবং আস্থার ঘাটতি সৃষ্টি হয়। ফলে কারা তাদের সঙ্গে মিশছে, কী ধরনের অসংগত আচরণ করছে তা বাবা-মায়ের অগোচরেই থেকে যায়। একটি সময় যখন সেই শিশুরা যৌন হয়রানির শিকার হতে শুরু করে তখনও তারা সমস্যা সৃষ্টির আশঙ্কা, লজ্জা বা উপেক্ষিত হওয়ার ভয়ে তা বাবা-মায়ের কাছে গোপন রাখে এবং দিনের পর দিন হয়রানির শিকার হতে থাকে।


৪. সচেতনতার অভাব : শিশুদের মধ্যে তাদের স্পর্শকাতর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সম্পর্কে যখন কোনো ধারণা না থাকে, তখন তারা ভালো আচরণ ও মন্দ আচরণের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে পারে না। ফলে কারো দ্বারা যৌন হয়রানির শিকার হলেও তারা তা অসংগতি হিসেবে নির্ণয় করতে ব্যর্থ হয়। বরং তারা নিজেরাও অনেকে সেই অসংগত আচরণে অভ্যস্ত হয়ে অন্য শিশুদের সঙ্গে তা প্রকাশ করে।

৫. প্রতিবন্ধিতা : গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, যৌন হয়রানির ক্ষেত্রে শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুরা স্বাভাবিকের চেয়ে অন্তত তিনগুণ বেশি ঝুঁকিতে থাকে। এর প্রধান কারণগুলোর মধ্যে আছে যত্নের প্রয়োজনীয়তা, গ্রহণযোগ্যতার আকাঙ্ক্ষা, অন্যের ওপর নির্ভরশীলতা, প্রতিবন্ধকতার কারণে অসদাচরণ এড়িয়ে যেতে না পারা এবং যোগাযোগ অক্ষমতার কারণে তা প্রকাশ করতে না পারা। 


প্রতিরোধে করণীয়

শিশুর প্রতি যৌন হয়রানি একটি সামাজিক সমস্যা হিসেবে যত বড়, এ বিষয়ে ততটা আলোচনা সমাজে নেই। নারীর প্রতি যৌন হয়রানির বিষয়ে সমাজে যেমন স্বচ্ছ ধারণা রয়েছে, শিশুর ক্ষেত্রে তেমনটি নেই। ফলে শিশুদের রক্ষণাবেক্ষণে যখন অবহেলা করা হয়, তখন কুকর্মকারীরা সেই অবহেলার সুযোগটি লুফে নেয়। শিশুদের যৌন হয়রানি থেকে সুরক্ষা দিতে বাবা-মায়ের সচেতনতা ও সতর্কতা প্রধান উপায়।

১. বাবা-মা হিসেবে সবসময় শিশুদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখুন যেন শিশু তার যেকোনো সমস্যা আপনাকে জানাতে দ্বিধা বোধ না করে। একই সঙ্গে শিশুকে সবসময় সাহস দিন। প্রতিদিন শিশুর সঙ্গে কাটানোর জন্য কিছু সময় বরাদ্দ রাখুন, যেন আপনার শিশু স্নেহ-ভালোবাসার অভাব অনুভব না করে। যে-সকল কথা বা কাজ কিংবা আচরণ শিশুর ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে, শিশুর সামনে তেমন আচরণ থেকে বিরত থাকুন। রাগ এবং অতিরিক্ত শাসন শিশুর ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।

২. শিশুকে তার শরীর এবং শরীরের স্পর্শকাতর অঙ্গ সম্পর্কে সচেতন করুন। কোথায় স্পর্শ করা যাবে, কোথায় স্পর্শ করা যাবে না তা শিখান। যেন অন্য কেউ তার স্পর্শকাতর স্থানে স্পর্শ করতে না পারে এবং সেও অন্য কোনো শিশুর স্পর্শকাতর স্থানে যাতে স্পর্শ না করে।

৩. শিশুর ব্যবহারযোগ্য ডিভাইসের প্রতি লক্ষ্য রাখুন। কি দেখা যাবে কি দেখা যাবে না তা তাকে শিখান। শিশুদের ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে সেটিংয়ে সীমাবদ্ধতা আরোপ করুন যেন অযাচিত কোনো ছবি বা ভিডিও তাদের সামনে না আসে।

৪. প্রতিবন্ধী শিশুর ক্ষেত্রে বিশেষ যত্ন নিন। তাকে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা সম্পর্কে শেখান। স্বাভাবিক যোগাযোগে অক্ষম শিশুদের জন্য বিকল্প যোগাযোগের সুযোগ সৃষ্টি করুন এবং তার মধ্যে হঠাৎ কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করলে তার কারণ অনুসন্ধানে উদ্যোগ নিন।

৫. শিশুদেরকে খেলাধুলা ও পাঠ্যক্রম বহির্ভূত কার্যক্রমে উৎসাহিত করুন। বাড়ির হালকা কাজেও তাকে যুক্ত হতে উৎসাহ দিন। এতে সে বাড়ির একজন মূল্যবান সদস্য হিসেবে আত্মবিশ্বাস পাবে।


আইনি সুরক্ষা

বাংলাদেশে নারী ও শিশুর সুরক্ষায় ২০০০ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন প্রণয়ন করা হয় যেখানে শিশু বলতে অনধিক ১৬ বছর বয়সের ব্যক্তিকে বুঝানো হয়। এই আইনটি প্রয়োজন অনুযায়ী একাধিকবার সংশোধন করা হয়েছে। বর্তমান সংশোধিত আইনের ধারা-১০ অনুযায়ী যদি কোনো ব্যক্তি অবৈধভাবে তার যৌন কামনা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে শরীরের যে কোনো অঙ্গ বা বস্তু দ্বারা কোনো নারী বা শিশুর যৌন অঙ্গ বা অন্য কোনো অঙ্গ স্পর্শ করেন বা কোনো নারীর শ্লীলতাহানী করেন তাহলে তার এই কাজ হবে যৌন পীড়ন এবং তজ্জন্য উক্ত ব্যক্তি অনধিক দশ বৎসর কিন্তু অন্যূন তিন বৎসর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন। এ ছাড়া ধর্ষণের শাস্তি হিসেবে সর্বোচ্চ মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে। ধারা ৯ (১) অনুযায়ী, যদি কোনো পুরুষ কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করেন, তাহা হইলে তিনি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন। আইনের উপধারায় ধর্ষণ চেষ্টা, ধর্ষণের পর হত্যা বা হত্যা চেষ্টার জন্য ভিন্নভিন্ন শাস্তির বিধান রয়েছে।


এ ছাড়া ২০০৯ সালে হাইকোর্ট নারী ও শিশুর প্রতি যৌন হয়রানি প্রতিরোধে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে ‘যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি’ গড়ার রায় দেয়। সে অনুযায়ী যেকোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী যৌন হয়রানির শিকার হলে নিজ প্রতিষ্ঠানে অভিযোগ করার আইনি অধিকার রাখে। তবে খুব কম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই হাইকোর্টের উক্ত রায় অনুযায়ী কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি থাকলেও ঘাটতি রয়েছে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সচেতনতা তৈরির উদ্যোগসহ অন্যান্য কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণে।

শিশুর সুরক্ষায় আইনের যথাযথ প্রয়োগের পাশাপাশি শিশুকে যেন আইনের দ্বারস্থ হতে না হয় সেজন্য শিশু যৌন নির্যাতনের মাত্রা শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসতে হবে। এলক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রয়োজন শিশুর প্রতি বাবা-মায়ের বিশেষ যত্ন সতর্কতা। একইসঙ্গে প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা। তবেই সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবে একটি শিশুবান্ধব পরিবেশ। সুরক্ষিত হবে দেশের সুন্দর ভবিষ্যৎ।







    জনপ্রিয়

    সর্বশেষ